মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধ
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নাজমুস সালেহীন ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ইপিআই (এমটিইপিআই) এস এম মিজানুর রহমানের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে।
উপজেলার ঘোড়দৌড় বাজারে লৌহজং প্রেসক্লাবের সামনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সকল নির্যাতিত কর্মচারীর ব্যানারে এ মানববন্ধন করে স্বাস্থ্য সহকারী, উপস্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য পরিদর্শকেরা।
মানববন্ধনকারীরা লিখিত অভিযোগে জানান, ডা. নাজমুস সালেহীন এমটিইপিআই এস এম মিজানুর রহমানের যোগসাজশে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিয়ম ও দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন- ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম, কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ, কোভিড-১৯, জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ, HPV টিকা, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস, বিশ্ব এইডস দিবস, যক্ষ্মা দিবস, কুষ্ঠ দিবস, মাতৃদুগ্ধ দিবস ইত্যাদি দিবসগুলোর বিল আত্মসাৎ করেছেন এ দুজন।
সচেতনতামূলক বিভিন্ন দিবসগুলোতে সরকার থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। র্যালি ও আলোচনা সভার জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার ব্যানার বানিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তা অনলাইনে পোস্ট দিয়ে দেন। বাকি টাকা আত্মসাৎ করেন ডাক্তার নজমুস সালেহীন ও এমটিইপিআই মিজানুর রহমান।
লোকাল ম্যানেজমেন্টের বরাদ্দ হিসেবে উপজেলার বেদেপল্লিতে ২ রাউন্ড, খড়িয়া বেদেপল্লিতে ২ রাউন্ড, খিদিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে ১ রাউন্ড, কাজির পাগলা এলাকায় ২ রাউন্ড, কাজির পাগলা এলাকায় ২ রাউন্ড, নোয়াপাড়া এলাকায় ২ রাউন্ড, শিমুলিয়া ঘাটে ২ রাউন্ড, পদ্মা সেতুর সেনাবাহিনীর ব্রাকে ১ রাউন্ড কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু উল্লেখিত টিকার ক্যাম্পেইনগুলো পরিচালনার জন্য অফিস থেকে কোনো খরচ প্রদান করা হয়নি।
এই লোকাল ম্যানেজমেন্টের জন্য বরাদ্দ ২০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নাজমুস সালেহীন ও তার সহযোগী এমটিইপিআই এসএম মিজানুর রহমান। জাতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনের অনিয়ম নিয়ে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি এবং হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইনে অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সরকারি চাকুরি বিধি অনুযায়ী প্রতি তিন বছর অন্তর প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৫ দিন ছুটিসহ এক মাসের মূল বেতনের সমান অতিরিক্ত শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এ ভাতা তুলতে গিয়ে এক হাজার থেকে ১,৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ছুটি ভোগ করবো না মর্মে মুচলেকা দিতে হয় এবং চাকুরী খতিয়ান বহিতে ছুটি ভোগ করা হয়েছে লিখে দেন।
বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করলে ডা. নাজমুস সালেহীন এমটিইপিআই এসএম মিজানুর রহমানের পরামর্শে তাদের বেতন-ভাতাদি বিনা কারণে মাসের পর মাস স্থগিত রাখেন। এমনকি প্রতিবাদকারীদের নথি হতে অফিস আদেশ সরিয়ে ফেলা হয়। ২০০৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ৭ জন স্বাস্থ্য সহকারীর চাকুরী স্থায়ীকরণের আদেশ, ২০১০ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ২০ জন স্বাস্থ্য সহকারীর পুলিশ ভেরিফিকেশন নথি থেকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে ফেলা হয়।
পরে ঘুষ দিয়ে চাকুরি স্থায়ীকরণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের আবেদনপত্র ও কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবসহ কাগজপত্র তারা গ্রহণ এবং নথিভুক্ত করেন না। এমনকি ডাকযোগে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বরাবর আবেদনপত্র পাঠালেও তা গ্রহণ করেন না। এর ফলে ডা. নাজমুস সালেহীন ইচ্ছা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে থাকেন।
ডা. নাজমু সালেহীনের নির্দেশে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও
বদলিকৃত কর্মচারীদের ছাড়পত্র, চাকরির খতিয়ান বইসহ অন্যান্য কাগজপত্র যথাসময়ে প্রদান করা হয় না। এতে কর্মচারীদের নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে বিলম্ব হয় এবং উল্লেখিত কাগজপত্র যথাসময়ে না পেলে কর্মচারীরা বেতন ও ভাতাদি যথাসময়ে গ্রহণ করতে পারেন না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লোকবল সংকট থাকলেও ডা. নাজমুস সালেহীনের অবাধ্য হলে তাকে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক অন্যত্র বদলি করা হয়। উপজেলায় স্বাস্থ্য সহকারীর পদ রয়েছে ৪৩ টি। কর্মরত আছেন মাত্র ২৩ জন। ডা. নাজমুস সালেহীন ও মিজানুর রহমানের অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি দুই স্বাস্থ্য সহকারী আজিজুল হক ও দিলীপ কুমার দাসকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
ডা. নাজমুস সালেহীন ও এমটিইপিআই এসএম মিজানুর রহমানের অনিয়ম, দমন-পীড়ন ও অর্থ জালিয়াতির বিরুদ্ধে যেসব কর্মচারী সোচ্চার, তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ দায়ের করে করা হয় বেতন ও ভাতা দিয়ে বন্ধ করা হয়, এসিআর খারাপ দেওয়া হয়, চাকুরির খতিয়ান বই লাল কালি দ্বারা লিখার হুমকি দেওয়া হয়, অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়, সকল প্রকার ছুটি না মঞ্জুর করা হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের নিকট বেয়াদব তকমা দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়, যাতে অভিযুক্ত কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ন্যায়বিচার না পায়।
আন্দোলনকারীরা গত শনিবার ছয় পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগ পত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল শনিবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায়। কিন্তু এদিন ডা. নাজমুস সালেহীন অনুপস্থিত ছিলেন। এমটিইপি আইএসএম মিজানুর রহমান প্রতিনিধি দলের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান।
ফোনে যোগাযোগ করা হলে নাজমুস সালেহীন পরদিন রবিবার আসবেন বলে জানান। রবিবার প্রতিনিধি দল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে এদিনও ডা. নাজমুস সালেহীন অনুপস্থিত ছিলেন। পরে ডা. সালেহীনের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাকির হোসেনের সাথে দেখা করেন। প্রতিনিধি দল ডা. নাজমুস সালেহীনকে দুই দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত থাকার আলটিমেটাম দেন। ইউএনও জাকির হোসেন সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্ম।
Leave a Reply