অর্থনীতি ডেস্ক:-
দেশের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতি বছর নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই সঠিক সময়ে শেষ হয় না। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত চার বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রায় ১৬০০ উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য যেমন ব্যাহত হচ্ছে, একই সঙ্গে বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে বাস্তবায়ন খরচ। প্রকল্প গ্রহণ ও পরিচালনায় দূরদর্শিতার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির এই দুর্বলতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণও ব্যাহত হচ্ছে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে ১ হাজার ৫৮৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ৪২৯টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, সদ্য বিদায়ী (২০২৩-২৪) অর্থবছরে ৩৭৫টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা। এর মধ্যে ৩৪৫টি প্রকল্পের প্রতিবেদন জারি করা হয়েছে। বাকি ৩০টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কয়েকটি প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় ৩৫৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমইডি। আর একনেক সভায় ৬০টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুটিই বাড়ানো হয়। এ ছাড়া ১৫টি প্রকল্প তিনবার মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ না হওয়া চতুর্থবার একনেকে উঠানো হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৮০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এর মধ্যে ৩২১টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমইডি। ৫৯টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে একনেক সভায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪০০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এর মধ্যে ৩৩৭টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে আইএমইডি। একনেক সভায় ৬৩টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, কিছু প্রকল্পে সময় বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ থাকে। অনেক দেশীয় প্রকল্প চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পায় না। তবে অনেক সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণে বাস্তবায়নে দেরি হয়। বেশিরভাগ প্রকল্প পরিচালকেরই প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কম। জমি অধিগ্রহণের ঝামেলা না থাকলে আর বরাদ্দ ঠিকমতো দেওয়া হলে সময় বাড়ানো ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলেও জানান তারা।
এ বিষয়ে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার বড় একটি কারণ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা এবং ফিজিবিলিটি স্টাডি না করা। প্রয়োজনীয়তা এবং বাস্তবতা বিবেচনা করেই অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এসব কারণে প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না, খরচ বেড়ে যায়।
এদিকে, বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পগুলো অর্থবছরের পর অর্থবছর টেনে নেওয়ায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মমূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণও ব্যাহত হচ্ছে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) এডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ২৪৬টি, যার বেশিরভাগই পুরোনো প্রকল্প। এর মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৪টি প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এ ছাড়া এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চললেও শেষ হয়নি ৩৬টি প্রকল্প।
সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এডিপিতে রাখা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রকল্প চারবার সংশোধিত হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে, এসব প্রকল্পের সংখ্যা ৫১৮। চলমান ১ হাজার ১৩৮টি প্রকল্পের গড় বয়স ৫ বছর ২ মাস। ৬ থেকে ১০ বছর ধরে চলছে ৩৫৭টি প্রকল্প। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ৩৬টি। এর মধ্যে ১০টি প্রকল্প চলছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৯৫ শতাংশ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। এসব প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে শেষ করতে হয়। জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে প্রায় ২৭ শতাংশ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। কাজের পরিধি পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে ৪৯ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে ব্যয় বাড়ে প্রায় ২৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো পর্যাপ্ত সম্ভাব্যতা যাচাই ও অংশীজনের মতামতের অভাব এবং কোনো এক্সিট প্ল্যান না থাকা। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালকদের কখন কোন কাজ করতে হবে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সেই পরিকল্পনা দেওয়া থাকলেও সে অনুযায়ী তারা সময়মতো কাজ করতে পারেন না। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার সংশোধন ও সময় বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। এতে যেমন ব্যয় বাড়ে তেমনি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিটার্ন পাওয়া যায় না। তাৎক্ষণিক না হলেও দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরী কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিতে যেমন অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং একই সঙ্গে প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে না। কাজেই পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বাস্তবায়ন দক্ষতা উন্নত করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির পেছনে মূল কারণ হচ্ছে সঠিকভাবে ফিজিবিলিট স্ট্যাডি না করা। যে কারণে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে মেয়াদ এবং খরচ বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালক এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার অদক্ষতার কারণে ধীরগতি দেখা দেয়। সুস্পষ্টভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে এ সমস্যা চলতেই থাকবে।
Leave a Reply